ধূ ধূ মাঠ। মাঝখানে একটা ফাঁকা রাস্তা। সেই রাস্তার ধারে একটা বিদ্যুতের খুঁটি। দু’দিকে তিনটে করে তার বেরিয়ে গেছে, আর আরও একটা সরু তার থেকে ঝুলছে ছোট্ট একটা বাল্ব।
বাল্বটা বেশি আলো
দেয় না। সন্ধ্যে থেকে টিমটিম করে জ্বলে, আর দিনের বেলায় হালকা হাওয়ায় আস্তে আস্তে
দোল খায়।
খুঁটিটা গোটা দিন
বাল্বটার দুলে দুলে খেলা দেখে, আর রাত্তিরবেলা তার মিঠে আলোয় চারপাশটায় চোখ বোলায়। দেখে, কাঁচা রাস্তাটাকে যেন সোনা দিয়ে মুড়ে দিয়েছে কেউ। আর একটু দূরে, দিনের বেলার
সবজেটে মাঠটা আলকাতরা মেখে শুয়ে আছে মড়ার মত; পরদিন ভোরের শিশিরের একটি কণার আশায়।
রাতজাগা পাখিরা খুঁটিটার
দু’দিকের তারের ওপর হয় জিরোয়, নয় খেতে বসে তাদের সেদিনকার শিকার। খুঁটিটা অবাক
চোখে তাদের দেখে, বুঝতে পারে না তাদের এই হিংসার উদ্দেশ্য। অবশ্য কিছুক্ষণ পরেই
তার ঘোর কেটে যায়। সে আবার তাকায় টিমটিম করে জ্বলে থাকা বাল্বটার দিকে, আর ফিরে
পায় নিজেকে। নিজের অস্তিত্বের উদ্দেশ্যকে। ফিরে পায় বলেই যখন রোদ-মাতাল মাঠ কালচে
ছায়ায় ঢেকে যায়, তখন ঝাপটা সইবার জন্য তৈরি করে নিজেকে। একটু পরেই শুরু হয় আঘাত। অদৃশ্য
কিছু যেন ঠেলে ফেলে দিতে চায় খুঁটিটাকে।
খুঁটিটা নিজের ভিত
আরেকবার পরখ করে নেয়। আঁকড়ে ধরে দু’পাশের তিনটে তিনটে ছ’টা তার। তারপর দাঁতে দাঁত
চেপে লড়াই করে সেই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে।
রাশি রাশি ধূলো হার মানে
সেই শক্তির কাছে। তারা ঝাপটার সঙ্গে ছিটকে আসে, আর কোথায় ভেসে চলে যায়। তারগুলোর
মধ্যেকার বিদ্যুতের প্রবাহ-ও বন্ধ হয়ে যায় আক্রমণের আশঙ্কায়। কিন্তু খুঁটিটা তার
শক্ত ভিতে দাঁড়িয়ে থাকে। তার গোটা শরীরে তীরের মত আছড়ে পড়ে পরাজিত ধূলোর রাশি। তবু কোনও কিছু গ্রাহ্য না করে যুদ্ধ চালিয়ে যায় সে। শুধু একটি ব্যাপারে সে ভয়
পেয়ে যায়।
সেই ছোট্ট বাল্বটা
সহ্য করতে পারে না এই আঘাত। ঝাপটার চোটে বাসা হারানো পাখির মত ছিটকে যেতে চায়
সেখান থেকে। ভয়ে শিউরে উঠে সরু তারটাকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে খুঁটিটা। গভীর উৎকণ্ঠায়
চেয়ে থাকে, তারটা ছিঁড়ে না যায়!
অবশেষে ঝাপটা থেমে
যায়। সবকিছু শান্ত হয়ে আসে। তখন রণক্লান্ত সৈনিকের মত স্থির হয়ে ঝুলে থাকে
বাল্বটা, অন্যদিনের মত দোল খায় না। পরিশ্রান্ত খুঁটিটা হাঁফাতে হাঁফাতে ব্যগ্র
চোখে খোঁজ করে, বাল্বটা ঠিক আছে তো!
একটু পরে একটা মৃদু
ঝাঁকুনি খুঁটিটাকে জানিয়ে দেয়, বিদ্যুৎপ্রবাহ আবার চালু হয়েছে। ওই দূরের বটগাছটার
ছায়া আর পাঁচ হাত লম্বা হলেই আবার জ্বলে উঠবে বাল্বটা, নতুন দ্যূতি নিয়ে।
আর যখন আঘাত
রাত্তিরবেলায় আসে, সবকিছু অন্ধকারে ডুবে যায়। বাল্বটাও নিভে যায়। খুঁটিটা তখন খুব
চেষ্টা করে বাল্বটাকে জড়িয়ে ধরতে, এই অসহ্য আক্রমণ থেকে তাকে বাঁচাতে। পারে না। তাই
যতক্ষণ ঝাপটা চলে, শঙ্কায় ভরে থাকে তার মন।
এইভাবে কাটে দিনের
পর দিন, মাসের পর মাস। সামনের মাঠে বাচ্চারা বল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে, কাঁচা রাস্তা
দিয়ে ক্রিং ক্রিং শব্দে সাইকেল ছুটে যায়, বিকেলে গরুর পাল সার বেঁধে ফিরে যায়
দূরের গ্রামটার দিকে...
এমনই এক সন্ধ্যা। ছেলেরা খেলে ফিরে গেছে যে যার বাড়ি। গরুর পালও প্রতিদিনের মত গ্রামের দিকে ফিরেছে। আবারও টিমটিম করে জ্বলে উঠেছে বাল্বটা।
হঠাৎ খুঁটিটা খেয়াল
করল, চারিদিক অস্বাভাবিক শান্ত। হাওয়া বইছে না কোনওদিক থেকে। বাল্বটাও আর দুলছে
না, যেন ভয়ে জড়সড়।
অশুভ সেই শক্তির
আগমনের পূর্বাভাস।
একটু পরেই
বিদ্যুতপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেল। টুপ করে নিভে গেল বাল্বটা, সব কিছু ঢেকে গেল আঁধারে। ভয়ে
সবকটা তারকে আঁকড়ে ধরল খুঁটিটা, আর শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে প্রথম আঘাতের প্রতীক্ষা করতে
লাগল।
প্রথম আঘাত। শান্ত
হাওয়াকে আচমকা এলোমেলো করে দেওয়া ঝাপটা। এটাই বলে দেয় অশুভ শক্তির এই হামলার জোর
কতটা।
খুঁটিটা শুনতে পেল,
দূর থেকে হোওওওওও শব্দে এগিয়ে আসছে সেই শক্তি। শব্দটা যতই জোরালো হতে লাগল ততই
শঙ্কিত হয়ে উঠল সে। এত জোর শব্দ তো আগে কখনও শোনে নি!
কড়কড় শব্দে একটা নীল
আলো চকিতের জন্য চারিদিক ঝলসে দিয়ে গেল। সেই আলোতেই ক্ষণিকের জন্য দেখতে পেল
খুঁটিটা, বিশাল এক ধোঁয়ার সমুদ্র প্রচন্ড বেগে এগিয়ে আসছে গ্রামটার পেছনদিক থেকে।
প্রথম ঝাপটা। পড়ে
যেতে যেতে সামলে নিল খুঁটিটা। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই শুরু করল।
রাশি রাশি ধূলো এসে
পড়ছে তার গায়ে। জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। তবু মনের ভয়কে উপেক্ষা করে খুঁটিটা তারগুলোকে
আরও শক্ত করে চেপে ধরে লড়াই চালাতে লাগল।
আবার কড়কড়। তবে এবার
আলোটা তেমন বোঝা গেল না। ধূলোয় ধূলোয় চারিদিক ঢেকে গেছে।
আঘাতের তেজ আরও বাড়ল। প্রতিটি ঝাপটা যেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। তবুও খুঁটিটা একটুও না নড়ে দাঁড়িয়ে রইল।
বহুক্ষণ ধরে এরকম
চলল। যত সময় কাটল, খুঁটিটা তার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল। সেও কিছু কম নয়। এত জোরে
আঘাতও সে সহ্য করতে পারে। দ্বিগুণ উৎসাহে সংগ্রাম চলতে লাগল।
হঠাৎ... প্রবল একটা
ধাক্কা। সঙ্গে সঙ্গে কড়কড় করে উঠল সেই নীলচে আলো। এক পলকের জন্য খুঁটিটা দেখতে
পেল, বিশাল আকারের একটা টিনের চালা তাকে ধাক্কা মেরে আবার উড়ে চলেছে ধূলোর
সমুদ্রে।
টলে গেল সে। চারটে
তার সাথে সাথেই ছিঁড়ে গেছে। কোনওক্রমে পতন ঠেকিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল খুঁটিটা।
ধীরে ধীরে ঝাপটা কমে
এল। সবকিছু আবার শান্ত হল। ক্লান্ত মাঠের ওপর নেমে আসতে লাগল বড় বড় জলের ফোঁটা। ভিজে মাটির গন্ধে বাতাস ভরে উঠল।
ভোর হল। থমথমে
পরিবেশ ভরে উঠল নরম আলোয়। খুঁটিটা তাকিয়ে দেখল, দূরের গ্রামের অনেক বাড়ি আর নেই। যেগুলো আছে, তাদের অর্ধেক মাথা-ভাঙ্গা।
এরপর খুঁটিটা নিজের
হেলে যাওয়া শরীরের দিকে তাকাল, আর চমকে উঠল।
সেই সরু তার, যেখান
থেকে বাল্বটা ঝুলত, সেখানে অবশিষ্ট রয়েছে একটা ধাতব চাকতি, কানায় কয়েকটা সূচালো
কাচের টুকরো নিয়ে।
এতক্ষণে খুঁটিটা
বুঝল, সে সত্যিই হেরে গেছে। আকাশজোড়া মেঘ থেকে আবার শুরু হল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি।
বৃষ্টি যখন থামল,
তখন সন্ধ্যা হয় হয়। আকাশ এখন পরিষ্কার। ওই দূরের বটগাছটার ছায়া ক্রমশঃ লম্বা
হচ্ছে। খুঁটিটা যেন বুঝেও বুঝল না, এবার অন্ধকার নেমে আসবে।
বুঝল, যখন দূরের
গ্রামটা একটা কালো ছায়ায় পরিণত হল। আচমকা তার মনে পড়ল, আঁধার নেমেছে, কিন্তু আজ তাকে
আলো দেওয়ার কেউ নেই... কেউ নেই... কেউ...
আজ অন্ধকার
অন্যদিনের চেয়ে বহু, বহুগুণ জমাট। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, এমনকি সামনের কাঁচা
রাস্তাটাও না। খুঁটিটার চারপাশে যেন নিকষ কালো একটা পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছে কেউ, আর আস্তে
আস্তে সেই পর্দা তার গলা পেঁচিয়ে ধরে চাপ দিচ্ছে; দম বন্ধ হয়ে আসছে তার...
এই প্রথমবার, বিকট
চিৎকারে বুকের সমস্ত ভয়, ক্ষোভ, দুঃখ, যন্ত্রণা উগরে দেওয়ার জন্য আকাশের দিকে মুখ
তুলল সে... আর চুপ করে গেল।
ছোট্ট একটা ডিঙ্গিনৌকোর
মত উজ্জ্বল আলো মাঝগগনে ভাসছে, আর বাকি আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে হাজার হাজার বিন্দু
বিন্দু আলো| কেউ মিটমিট করছে, কেউ বা একবার পলক না ফেলে তাকিয়ে রয়েছে।
খুঁটিটার মনে কৌতুহল
জাগল। সে দেখতে লাগল আলোগুলোকে, ঘন্টার পর ঘন্টা।
কিছু সময় পরেই সে বুঝল,
আকাশ থেমে নেই। ডিঙ্গিনৌকোটা মাঝ আকাশ থেকে ঢলে পড়ল একদিকে। বিন্দুগুলোও এদিক থেকে
ওদিক যেতে লাগল। খুঁটিটার জন্য কেউ একমুহুর্ত-ও দাঁড়াল না, যেন দেখেই নি। আবার মনে
পড়ে গেল, এখন বাল্বটা নেই। আজ তাকে আলো দেবার ভরসা কেউ দেবে না। গোটা দুনিয়ায় আজ
সে একা, ভীষণ একা।
ভারী মন নিয়ে উদাসীন
চোখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল খুঁটিটা, আর হঠাৎ থমকে গেল।
যেদিকটা থেকে খুব
রাত্তিরে কনকনে হওয়া বয়ে আসে, সেইখানে একটা বিন্দু সন্ধ্যেবেলায় যেখানে ছিল
সেখানেই আছে এখনও। আশ্চর্য্য হয়ে খুঁটিটা দেখতে লাগল বিন্দুটাকে। এক ঘন্টা, দু’ঘন্টা...
বিন্দুটা সেখানেই রইল, একই রকম মিটমিটে আলো নিয়ে। আর তার আলোটা একদম সেই বাল্বটার
মত। সেই একই রকম টিমটিমে অথচ উজ্জ্বল জ্যোতি। দূরে, অথচ একেবারে স্থির...
খুঁটিটা নিষ্পলক
নয়নে তাকিয়ে রইল।
২০০৬
No comments:
Post a Comment