কোষের মস্তিষ্ক ( পর্ব - ২ )


পরদিন সকালে অচিন্ত্য প্রফেসরের বাড়ি পৌঁছে গেল। একজন চাকর তাকে ঘর দেখিয়ে দিল। দিনটা রবিবার তাই অফিস ছিল না। সে সারাদিন বই পড়ার চেষ্টা করল, পারল না। মন পড়ে আছে সন্ধ্যেবেলার এক্সপেরিমেন্টের ওপর। বিকাশ মহাপাত্রের দেখা মেলেনি, উনি সারাদিন ল্যাবে ব্যস্ত।

অবশেষে ছ’টা বাজতে পাঁচে প্রফেসর দরজায় নক করলেন, “চলে এসো।”

অচিন্ত্য প্রফেসরের পিছু নিল। যেতে যেতে প্রফেসর বললেন, “এখানে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো?”

“না না।”

“কেশবকে কেমন লাগল? খাবার ঠিকঠাক দিয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

“এই কেশব, রাঁধুনী কাম কেয়ারটেকার, আর দারোয়ান রঘুনাথ- এদেরকে নিয়েই আমার সংসার,” হেসে বললেন অধ্যাপক।“সমস্ত ঘরদোর ওরাই পরিষ্কার রাখে।ওরা না থাকলে আমার পক্ষে একা বাস করা সম্ভব ছিল না।”

ল্যাবে পৌঁছে অচিন্ত্য দেখল, কেশব আর রধুনাথ আগে থেকেই সেখানে আছে।জি.সি.এম.আর.-এর ঝাঁ-চকচকে কন্ট্রোল প্যানেলে লাল-নীল আলো জ্বলছে।পরীক্ষার সমস্ত ব্যবস্থা হয়ে গেছে।

প্রফেসর বললেন, “পরীক্ষা চলাকালীন আমি যা বলব তোমাকে তাই করতে হবে।কোনও প্রশ্ন করার সময় এখন নয়।”

অচিন্ত্য মাথা নাড়ল।প্রফেসর প্যানেলে চোখ রেখে বললেন, “যন্ত্রের ভেতরে ঢোকো।”

অচিন্ত্য চটি খুলে রেখে কেশবের খুলে ধরা দরজা দিয়ে জি.সি.এম.আর.-এর কাচে ঢাকা টিউবে শরীর গলিয়ে দিল।কেশব দরজা বাইরে থেকে সীল করে দিল।

প্রফেসর প্যানেলের পাশ থেকে একটা মাইক্রোফোন তুলে নিয়ে বলতে লাগলেন, “তুমি এখন আছ পঁচিশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড, সাতশো ষাট মিলিমিটার অফ এইচ জি প্রেশারে।রেডিয়েশনের পরীক্ষা হবে তোমার ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে।”

অচিন্ত্য মাথা নাড়ল।প্রতিটি কথা সে একটা সাউন্ড সিস্টেমের মাধ্যমে শুনতে পাচ্ছিল।

“এবার রেডিয়েটরের আউটপুট টিউবের রাবারের আবরণ টেনে নিজের আঙুলে পরাও।”

অচিন্ত্য টেবিল-ল্যাম্প সদৃশ আউটপুট টিউবে হাত বোলাতেই রাবারের একটা আবরণ অনুভব করল।সেটাকে সে ধরে টান দিতে পাতলা রাবার লম্বা হয়ে এল।সে তার বুড়ো আঙুল তার মধ্যে ঢোকালে সেটা চামড়ার ওপর চেপে বসল।প্র্ফেসরের নির্দেশ এল, “এবার শুয়ে পড়ো।” অচিন্ত্য তাই করল।
“এবার শুরু।থ্রী, টু, ওয়ান...”


প্রফেসর প্যানেলে একটা বোতাম টিপতেই অচিন্ত্যর আঙুলে যেন হাতুড়ির ঘা পড়ল।সে চি‌‍ৎকার করে উঠে বসতেই অচিন্ত্য টের পেল যে ব্যথাটা সম্পূর্ণ উবে গেছে।

“ঠিক আছো?” প্রফেসরের উদগ্রীব প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল অচিন্ত্য।

“এবার, অচিন্ত্য... আঙুল বার করো।”

অচিন্ত্য একটানে রাবারের আবরণটা খুলে ফেলল, আর যা দেখল তাতে স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইল।

ঠিক সেই রেডিয়েটেড কোষগুলোর মত তার বুড়ো আঙুলটাও সেই অস্বাভাবিক, অপার্থিব নীল রংটা ধারণ করেছে।

                             ----

অচিন্ত্যর আঙুলে রং ছাড়া তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি।প্রথমদিন রাতে বার তিনেক ঘুম থেকে উঠে নিজের পা পর্যবেক্ষণ করলেও পরদিন সকালে অফিসের তাড়ায় সে তার নীলচে আঙুলের কথা ভুলেই গেল।ব্রেকফাস্টে প্রফেসর-ও এই নিয়ে কোনও প্রশ্ন করলেন না।শুধু বলে দিলেন সে যেন অফিসে গিয়ে বলে যে তিনি কোনও ইন্টারভিউ দেন নি, তার সঙ্গে আড্ডা মেরেছেন শুধু।

সেদিন মাঝরাতের পরে অচিন্ত্য প্রফেসরের সঙ্গে বসে টিভিতে চ্যাম্পিয়ন্স লীগে আর্সেনালের একটা খেলা দেখছিল।হঠাৎ টেবিলে রাখা একটা অ্যালার্ম ঘড়ি বেজে উঠল।

অ্যালার্ম বন্ধ করে প্রফেসর বললেন, “এখন বারোটা দশ।তোমার ওপর এক্সপেরিমেন্ট করার পর তিরিশ ঘন্টা পেরিয়েছে।এবার বলো, তোমার পা কেমন আছে।”

অচিন্ত্য চটি খুলে আঙুলে হাত দিল, সেটাকে একবার নাড়াল।তারপর ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আঙুলটা কেমন যেন ভারী ঠেকছে।”

প্রফেসর সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন, “ল্যাবে চলো।”

পরীক্ষাগারে এসে অধ্যাপক অচিন্ত্যর আঙুল থেকে কোষের নমুনা সংগ্রহ করে মাইক্রোস্কোপে দেখলেন, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।

“তোমার কোষ বড় বুদ্ধিমান হে অচিন্ত্য, খাবার জমা করছে।”

অচিন্ত্য বুঝতে পারল না, “মানে?”

“মানে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়।”

“কিন্তু কেন?” অচিন্ত্য অবাক হয়ে গেল।

“কারণ তোমার আঙুল এখন একটা সমষ্টি; যাকে মাইক্রো-অরগানিজম দের কলোনি, আর খাদ্যসঞ্চয় যে কোনও জীব-ই করে থাকে,” বললেন প্রফেসর।“কোষগুলো ওদের বরাদ্দ রেশনের বেশি খাবার সংগ্রহ করে ভ্যাকুওল অর্থাৎ কোষগহ্বরে জমিয়ে রাখছে।তাই তোমার পা ভারী ঠেকছে।সে কোনও চিন্তার ব্যাপার নয়।এখন তুমি বরং গিয়ে দেখো ফ্যাব্রেগাস গোল করল নাকি...”

“আর আপনি?” প্রশ্ন করল অচিন্ত্য।

“আমি এক্সপেরিমেন্ট লগ-এ সমস্তটা আপডেট করে আসছি।”

অচিন্ত্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও পা বাড়াল।

                             ----

পরদিন অফিস যাওয়ার সময় মোজা পরতে গিয়ে চমকে উঠল অচিন্ত্য।তারপর উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে প্রফেসরের ঘরের সামনে গিয়ে কড়া নাড়ল।

অধ্যাপক দরজা খুলে বললেন, “এনি প্রবলেম?”

“আমার ডান পায়ের সবকটা আঙুল নীল হয়ে গেছে!” বলল অচিন্ত্য, “আর একটাতেও কোনও সেন্স নেই!”

“চলে এসো,” বলেই ল্যাবের দিকে হাঁটা দিলেন প্রফেসর।

ল্যাবে এসেই এককোনায় রাখা একটা বেডে অচিন্ত্যকে শুয়ে পড়তে বললেন তিনি।তারপর একটা ভোঁতা ছুরি নিয়ে অধুনা নীল আঙুলগুলোর ওপর জোরে জোরে ঘষতে লাগলেন কোষের নমুনা নেওয়ার জন্য।কিন্তু বারবার চেষ্টাসত্ত্বেও কোনও কোষ উঠে এল না।প্রফেসর হাল ছেড়ে দিয়ে বসে পড়লেন।

দুরু দুরু বুকে অচিন্ত্য উঠে বসল, “প্রফেসর, সব ঠিক আছে তো?”

“না... মানে, সেরকম কিছু নয়,” অচিন্ত্যর পায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন প্রফেসর, “তবে এত তাড়াতাড়ি হবে আশা করিনি।”

অচিন্ত্য আবার জিজ্ঞাসা করল, “প্রফেসর, ব্যাপারটা কি? কি হচ্ছে আমার পায়ে?”

“প্রাণীদের সাধারণ ধর্ম যা, ওরা তাই করছে,” বললেন প্রফেসর।“ওরা নিজেদের সংখ্যা বাড়াচ্ছে।”

“বংশবিস্তার করছে সেটা আমিও আন্দাজ করেছিলাম,” বলল অচিন্ত্য।“কিন্তু আঙুলগুলোয় সেন্স নেই কেন?”

“ওরা সংখ্যার সঙ্গে নিজেদের এলাকায় প্রভাব-ও বাড়াচ্ছে,” বললেন অধ্যাপক।“লক্ষ্য করলে না, ছুরি ছোঁয়াতেই প্রত্যেকটা কোষ কেমন শক্ত হয়ে গেল? একটাও বেরিয়ে এল না।ওদের পুরো সমষ্টি এখন একজোটে কাজ করছে, একে অপরকে প্রটেক্ট করছে।”

“তার মানে তো আস্তে আস্তে আমার গোটা শরীরই এরকম কোষে ভরে যাবে?” অচিন্ত্যকে একটা আতঙ্ক হঠাৎ পেয়ে বসছে।

“তার একটা সম্ভাবনা তো থাকছেই,” বললেন প্রফেসর।

“তাহলে আমাকে অ্যান্টিডোট দিন, আমি মুক্তি পেতে চাই।”

“আরে, অ্যান্টিডোট তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না,” উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর।“ তোমার হাঁটু অবধি বাড়তে দাও, তারপরেই দিয়ে দেব।এতে তো রিস্কের কোনও ব্যাপার নেই, তাই তাড়াহুড়ো না করলেও চলবে।তাছাড়া তোমার এই অবস্থায় থাকাটা আমার কাছে খুব জরুরী।”

“কেন? আপনি তো অন্য প্রাণীর ওপর আগেও পরীক্ষা করেছেন? এই অবস্থায় কোষগুলো কিরকম ব্যবহার করে তা তো আপনার অজানা নয়! তাহলেও আমাকে অ্যান্টিডোট দিচ্ছেন না কেন?” অচিন্ত্য যে কোনও মূল্যে এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চাইছিল।

প্রফেসর বললেন, “এই রেডিয়েশনের ফলে শারীরিক কি পরিবর্তন হয় তা জানলেও পরীক্ষাধীন সাবজেক্টের মনে এর কি প্রভাব পড়ে তা জানি না।কারণ গিনিপিগের ভাষা আমি বুঝি না।আর তাছাড়া...” গলা নামালেন প্রফেসর, “...অ্যান্টিডোট ছাড়া আর কোনও উপায়েই এই রেডিয়েশনকে  থামানো যায়নি।আর যতক্ষণ রেডিয়েশন বজায় থাকে, কোষগুলোকেও কোনওভাবে ম্যানিপুলেট করা যায় না।হতে পারে অ্যান্টিডোট ছাড়া এর কোনও ধ্বংস নেই... হতে পারে অ্যান্টিডোট ছাড়া এ অমর!”

“অমর?” অস্ফূটে বলল অচিন্ত্য।
                               ----

পরের দু’দিনে অচিন্ত্যর ডান পায়ের পুরো পাতাটাই নীল হয়ে গেল।রেডিয়েটেড কোষের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পা’টাও ভারী হয়ে যাচ্ছিল।অচিন্ত্য এখন তাড়াতাড়ি চলতে গেলে একটু একটু খোঁড়াচ্ছিল।
প্রফেসর প্রতি সন্ধ্যায় তার পায়ের ওপর বিভিন্ন ধরণের সলিউশন প্রয়োগ করলেন কিন্তু কিছুতেই 

কোষগুলোর ওপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারলেন না।অচিন্ত্য-র পায়ে কোনও সাড় না থাকায় পরীক্ষা চলাকালীন সে কিছু টেরই পেল না।

অচিন্ত্যর মন শঙ্কামুক্ত মোটেই হয় নি।এই গিনিপিগ-গিরি সে ছেড়েই দিত যদি না প্রফেসর ওই বিস্ফোরক তথ্যটা দিতেন।অমরত্ব! পা যতই ভারী হোক না কেন, এর লোভ সে সামলাতে পারে নি।
ঘটনাটা ঘটল তৃতীয় দিন অফিসে।

শুক্রবারের বিজ্ঞানের পাতার জন্য একটা লেখা নিয়ে এডিটরের ঘরের দরজার দিকে এগোচ্ছিল অচিন্ত্য।হঠাৎ সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন তাদের সব-এডিটর সমীরবাবু, আর অন্যমনস্কভাবে অচিন্ত্যর দিকে পা বাড়ালেন...

মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়াতে একঝটকায় কিছুটা ডানদিকে সরে এল অচিন্ত্য, কিন্তু কাঁধে-কাঁধে ধাক্কা এড়াতে পারল না।অচিন্ত্যর হাত থেকে কাগজ ছিটকে গেল।সমীরবাবু টাল সামলাতে গিয়ে অচিন্ত্যর ডান পায়ের পাতা মাড়িয়ে ফেললেন।

সঙ্গে সঙ্গে একটা নীল রঙের দড়ির মত কিছু একটা অচিন্ত্যর জুতো বেরিয়ে এসে সমীরবাবুর পা জড়িয়ে ধরে মোক্ষম টান দিল।সমীরবাবু চিত হয়ে পড়ে গেলেন।

অচিন্ত্যর মাথায় যেন বাজ পড়ল।‘সরি’ বলার কথাও মাথায় এল না।

“এ কি অচিন্ত্য? একটু দেখেশুনে চলতে পারো না? দ্যাখো তো...”

এডিটরের ধমকে চমক ভাঙল অচিন্ত্যর।দু’জন স্টাফ তখন সমীরবাবুর হাত ধরে তুলে দাঁড় করাচ্ছে।
তিনি হাসিমুখে বললেন, “ইটস অল রাইট।কিছু হয়নি।আমারই দোষ, আমি ভালো করে দেখিনি।”

“কিছু হয়ে গেলে কি হত?” এডিটর বললেন, “আর... কি ব্যাপার অচিন্ত্য? এত ঘামছ কেন? শরীর ভালো আছে তো?”

অচিন্ত্য কপাল ছুঁয়ে দেখল, ভেজা।ঘাম গড়িয়ে এখন চোখে নামবার পথে।সে কোনমতে বলল, “স্যার, আমার মাথাটা একটু ধরেছে।আজকের দিনটার জন্য ছুটি পেতে পারি?”

ভ্রূ কুঁচকে এডিটর বললেন, “মাথা ধরেছে? বেশি ধরেনি তো? আচ্ছা যাও।ডাক্তার দেখিয়ে নিও, আর সাবধানে যেও।ওকে?... হ্যাঁ ভালো কথা, তোমার স্টোরিটা কদ্দুর?”

সমীরবাবু মেঝে থেকে কাগজটা তুলে দিয়ে বললেন, “এই যে।”

অচিন্ত্য এডিটর ও সমীরবাবু উভয়কেই ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে পড়ল।ভাগ্যিস জুতোর ফুটোটা কারও চোখে পড়েনি।

প্রফেসরের বাড়িতে এসেই অচিন্ত্য তাঁকে সমস্ত ঘটনা বলল।তিনি মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে শুনলেন।তারপর অচিন্ত্যকে ল্যাবে নিয়ে গিয়ে আবার বেডে শোয়ালেন।

তারপর কোথা থেকে একটা চ্যালা কাঠ নিয়ে এসে অচিন্ত্যর ডান পায়ের পাতা লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলেন।পায়ে লেগে কাঠটা ছিটকে উঠতেই অচিন্ত্যর পায়ের পাতা অবিশ্বাস্য গতিতে দড়ির মত লম্বা হয়ে শুন্যেই সেটাকে জড়িয়ে ধরে এক ঝটকায় দু’ টুকরো করে ফেলে দিয়ে আবার নিজের সাধারণ আকারে ফিরে গেল।প্রফেসর টুকরো দু’টোর দিকে তাকিয়ে রইলেন।অচিন্ত্য উঠে বসল।

প্রফেসর জিজ্ঞাসা করলেন, “এটা কি তোমার ইচ্ছানুসারে হচ্ছে?”

অচিন্ত্য বলল, “না।”

“রেডিয়েটেড পার্টে কোনও অনুভুতি টের পেলে? ব্যথা বা কিছু?”

অচিন্ত্য দু’দিকে মাথা নাড়ল।প্রফেসর জি.সি.এম.আর.-এর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।অচিন্ত্য উঠে দাঁড়াল, “প্রফেসর, এসব কি হচ্ছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“খারাপ কিছুই হয়নি,” বলে প্রফেসর দরজার দিকে হাঁটা দিলেন।অচিন্ত্য ছুটে গিয়ে তাঁকে আটকালো।
প্রফেসর বললেন, “এই নিয়ে আমরা পরে কথা বললেই ভালো।”

“আমি আপনার ভলান্টিয়ার স্বেচ্ছায়, নিঃস্বার্থে হয়েছি,” কঠিন মুখে বলল অচিন্ত্য।“এই পরীক্ষার সমস্ত ফল, ভালো খারাপ দুটোই, জানার অধিকার আমার আছে।এটা আমার জীবন-মরণের প্রশ্ন।”

“লাইফ-রিস্কের কোনও ব্যাপার এখানে নেই,” বললেন প্রফেসর।

অচিন্ত্য এবার উত্তেজিত হল, “তাহলে আমাকে কিছু বলছেন না কেন?”

প্রফেসর চুপ করে রইলেন।

“দেখুন, আপনি এই মুহুর্তে আমাকে সব কথা খুলে না বললে আমি থানা-পুলিশ করব,” কড়া গলায় বলল অচিন্ত্য।“আর আমার কাছে প্রমাণ-ও যথেষ্টই আছে।”

প্রফেসর দেওয়ালের একটা চার্ট খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে লাগলেন।

“আপনি বলবেন না তাহলে,” অচিন্ত্য দরজার দিকে পা বাড়াল।

“দাঁড়াও,” প্রফেসর মুখ না ঘুরিয়েই বলে উঠলেন।

অচিন্ত্য দাঁড়াল।প্রফেসরও ঘুরে তার মুখোমুখি দাঁড়ালেন।

“কোষগুলো যখন নিজেদের এলাকায় তোমার নিয়ন্ত্রণ কমাচ্ছিল তখন ওরা শুধু স্পর্শ-চেতনারই দখল নিচ্ছিল না,” শান্ত গলায় বললেন প্র্ফেসর।“ওরা তোমার পেশী, হাড় সবকিছুর ওপরেই নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছিল।ওরা নিজেদের এলাকার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চায়, খাদ্যসঞ্চয় থেকে শুরু করে নড়াচড়া... সবকিছুর ওপরে।আপাততঃ ওরা তোমার হাঁটাচলা ইত্যাদিকে সাপোর্ট করছে কারণ তোমাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখা ওদের পক্ষে সুবিধার, কিন্তু যে মুহুর্তে ওরা মনে করেছে যে ওদের আক্রমণ করা হচ্ছে, ওরা প্রয়োজনমত নিজেদের এলাকা নিজেরাই ডিফেন্ড করছে।”

অচিন্ত্য বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে রইল।এভাবে চলতে থাকলে এখন একদিন সে সমস্ত শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাবে, পঙ্গু হয়ে যাবে...

“প্রফেসর, আমাকে অ্যান্টিডোট দিন।এখনই।”

“সেটার জন্য তোমাকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে,” জবাব দিলেন প্রফেসর।“কারণ সেটা এখনও তৈরিই হয়নি।”

আবার বজ্রপাত।এবার আরও ভয়ঙ্কর।

“অবশ্য পরীক্ষা এগোচ্ছে,” বললেন অধ্যাপক।“তবে একটু সময় লাগবে।”

“কত সময় লাগবে?” কোনওক্রমে বলল অচিন্ত্য।

“মোটামুটি তিন-চার মাস।”

“কিন্তু এই রেডিয়েশন তো তার আগেই আমার গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে!”

“তা ঠিক।”

আরও একবার বজ্রপাত।অ্যান্টিডোটের অপেক্ষায় অথর্ব হয়ে বসে থাকতে হবে তাকে? জড়বস্তুর মত? কিন্তু এছাড়া উপায় কি?

পরক্ষণেই আর একটা চিন্তা এসে ধাক্কা মারল অচিন্ত্যর মাথায়।প্রফেসর সত্যি কথা বলছেন তো? আর যদি বলেও থাকেন, আবিষ্কার কি আর দিনক্ষণ মেনে হয় যে উনি অ্যান্টিডোট তৈরি করে ফেলবেন তা নিশ্চিত?

“আপনি প্রথম থেকে আমাকে ঠকিয়ে আসছেন,” চড়া গলায় বলল অচিন্ত্য।“একজনের জীবনকে এইভাবে বিপন্ন করতে হাত কাঁপল না আপনার?”

প্রফেসর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।তারপর বললেন, “আমার চিরকালের বিশ্বাস ছিল যে বিজ্ঞানের কাজে কিছু দিলে পাঁচগুণ ফেরত পাওয়া যায়।এই আশাতেই বুক বেঁধে সতেরো বছর আগে আমি এই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।এতটাই মশগুল হয়ে পড়েছিলাম যে বাবা-মায়ের পরপর মৃত্যুও আমাকে নড়াতে পারেনি।”

প্রফেসর জি.সি.এম.আর.-এর কন্ট্রোল প্যানেলে কিসব টেপাটেপি করতে করতে বলে চললেন, “সবই 
ঠিকঠাক চলছিল।নিজের সামনে একটা উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিলাম।অর্থ, যশ... আরও কত কি! মরিয়ে হয়ে পাগলের মত খরচা করলাম এই প্রজেক্টে।অবশেষে আজ থেকে মাস তিনেক আগে আমার বহু পরিশ্রমের ফসল এই জি.সি.এম.আর. আবিষ্কৃত হল।”

প্রফেসর তাঁর যন্ত্রে হাত বোলালেন।তারপর বললেন, “কিন্তু ততদিনে আমি গলা পর্যন্ত্য ঋণে ডুবে গেছি।বাড়ি, সম্পত্তি সব বাঁধা পড়েছে।আমার যন্ত্র কমপ্লিট. গিনিপিগের ওপর পরীক্ষাও হয়ে গেছে।কিন্তু মানুষের ওপর পরীক্ষা না করলে এর ব্যবসায়িক মূল্য থাকবে না।আর অ্যান্টিডোট না থাকলে আইন মেনে মানুষের ওপর পরীক্ষা করাও যাবে না।তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, অ্যান্টিডোট তৈরি হওয়ার আগেই মানুষের ওপর পরীক্ষা শুরু করব।কাজটা বে-আইনি, ভলান্টিয়ার বিশ্বাসী হওয়া চাই।এমন লোক পাওয়া আমার পক্ষে সহজ নয়।অগত্যা তোমাদের এডিটর রাজেনকে ধরলাম।ও তোমাকে প্রেসক্রাইব করল।”

অচিন্ত্য এতক্ষণ স্থির হয়ে শুনছিল।এবার মুখ খুলল, “এডিটর সাহেবও এর মধ্যে ছিলেন?”

“আমার যন্ত্র নার্ভের অসুখ সারাতে পারে শুনেই তোমার কথা বলল,” উত্তর দিলেন প্রফেসর।

অচিন্ত্য অবাক হল, “উনি আমার অসুখের কথা জানলেন কি করে?”

“তুমি যে নিউরোসার্জেন-এর কাছে চেক-আপ করিয়েছিলে তিনি রাজেনের বন্ধু,” বললেন প্রফেসর।“সে যাক গে... তোমাকে আনলাম, টোপ দিলাম, তুমি গিললে।”

অধ্যাপক অচিন্ত্যর দিকে তাকিয়ে হাসলেন।অচিন্ত্য কোনও প্রতিক্রিয়া দেখল না।প্রফেসর আবার বলে চললেন, “তুমি এলে, একসাথে দুটো পরীক্ষা চলল।মানুষের ওপর এক্সপেরিমেন্ট আর অ্যান্টিডোট তৈরি।কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াল মানুষের শরীরে রেডিয়েটেড কোষের অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়া, অন্ততঃ তোমার ক্ষেত্রে।গিনিপিগের যা হতে এক মাস লেগেছিল, তোমার হল মাত্র চার দিনে।তারপর তুমি এমন চাপ দিলে যে আজ গোটা পরীক্ষাটা সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছেও প্রশ্নচিন্হের মুখে পড়েছে।”

প্রফেসর অচিন্ত্যর কাছে এগিয়ে এলেন, “অচিন্ত্য, এই মোমেন্ট অফ ক্রাইসিসে আমাকে ছেড়ে যেও না।এই নীল কোষ তোমার পেরিফেরাল নিউরপ্যাথি পুরোপুরি সারিয়ে তুলবে, আর অ্যান্টিডোট তৈরি হয়ে গেলেই তুমি স্বাভাবিক শরীর ফিরে পাবে।তারপর তোমাকে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নেব।বিজ্ঞানের ইতিহাসে তোমার অবদানের কথাও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে!”

অচিন্ত্য কঠিন স্বরে বলল, “অ্যান্টিডোট তৈরির গবেষণার নোটগুলো আমাকে দেখাতে পারেন?”

“আপাততঃ সেটা অসম্ভব,” জবাব দিলেন প্রফেসর।“আর দেখালেও তুমি বুঝবে না, ওগুলো কোডে লেখা।”

“হাঃ!” তীব্র শ্লেষ ঝরে পড়ল অচিন্ত্যর গলা থেকে, “তাহলে আপনাকে বিশ্বাস করি কি করে? যে একটা মিথ্যা কথা বলতে পারে সে তো গন্ডায় গন্ডায়...”

“তুমি আমাকে ভুল বুঝো না অচিন্ত্য!”

“আর কি বুঝবো! আপনি একটা প্রতারক।আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন! আমাকে শেষ করে দিয়েছেন! এখন এই অবস্থা থেকে আমার মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় ডান পা-টা কেটে বাদ দেওয়া!” গলা কেঁপে উঠল অচিন্ত্যর, “আমার যা হয় হবে, কিন্তু আপনাকে আমি ছাড়ব না।আপনার শাস্তি হবেই!”
অচিন্ত্য দরজার দিকে পা বাড়াল।

প্রফেসর চিৎকার করলেন, “দাঁড়াও!”

অচিন্ত্য ঘুরে দাঁড়াল, “আমি আপনার কোনও কথা শুনব না! আপনি...”

হঠাৎ পেছনে একটা শব্দ পেয়ে আবার ফিরে দাঁড়াল অচিন্ত্য।দেখল, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রধুনাথ।মুহুর্তে সে লাঠি হাতে অচিন্ত্যর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।প্রথম আঘাতটা ফসকে গেল, রঘুনাথ দ্বিতীয়বার লাঠি তুলল।

স্প্রিংয়ের মত লাফিয়ে উঠে অচিন্ত্য বাঁ পায়ে রঘুনাথের চোয়ালে লাথি কষাল।রঘুনাথ পড়ে যেতেই সে আবার লাফিয়ে উঠে পুরো ওজন নিয়ে তার পেটের ওপর পড়ল।রঘুনাথ ককিয়ে উঠল।অচিন্ত্য উঠে দাঁড়িয়ে প্রফেসরের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে দরজার দিকে ফিরল।

তখনই, বুকে একটা প্রচন্ড যন্ত্রণা শুরু হল।যেন কিছু একটা ফুটে গেছে হৃৎপিন্ডে।

ডুকরে উঠে অচিন্ত্য বিস্ফারিত চোখে দেখল, তার বুকে বিঁধে আছে একটা বড় আকারের ছোরা, আর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে কেশব।

কয়েক মুহুর্তের গোঙানি আর বাতাসে কিছু একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা।তারপরেই কাটা কলাগাছের মত পড়ে গেল অচিন্ত্য।মেঝেতে দেহ মোচড়াতে মোচড়াতে কোনওক্রমে ছোরাটা টেনে বের করল সে, কিন্তু সেটা ধরে রাখতে পারল না।ছোরাটা তার হাত থেকে পড়ে গেল।

চোখের সামনেটা ফিকে হয়ে আসতে লাগল তার।প্রতিটি শ্বাসে ঘড়ঘড় শব্দ আর অসহ্য ব্যথা।বুকের ফুটোটা আঙুলের ফাঁক দিয়ে প্রতি মুহুর্তে উগরে দিচ্ছে উষ্ণ তরল।এর মধ্যেই অচিন্ত্য দেখতে পেল, তার মাথার কাছে ঝুঁকে পরেছেন প্রফেসর।

“জি.সি.এম.আর.-এর কন্ট্রোল প্যানেলে একটা অ্যালার্মের বোতাম-ও আছে, যেমনটা থাকে ব্যাঙ্কে,” যেন অজুহাত দিলেন প্রফেসর।তারপর গলা নামালেন, “আমি এটা চাইনি।তুমিই বাধ্য করলে।”

এত কষ্টেও ঘৃণায় চোখ জ্বলে উঠল অচিন্ত্যর।সে সমস্ত শক্তি একত্র করে ডান পা তুলে প্রায় ডিগবাজি খেয়ে প্রফেসরের গলায় লাথি মারল।

লাথি খেয়ে প্রফেসর পড়ে যাওয়ার আগেই একটা নীলচে সাপ তাঁর গলা পেঁচিয়ে ধরল, আর পিষতে লাগল...

অচিন্ত্য তখন নিশ্চল।তার পাশেই লুটিয়ে পড়লেন সদ্য বন্ধনমুক্ত প্রফেসর।

রঘুনাথ আর কেশব বিস্ফারিত চোখে সব দেখল।তারপর প্রচন্ড আতঙ্কে দুজনেই দৌড়ে পালাল সেখান থেকে।

বাড়ির চিলেকোঠা থেকে এক নিশাচর পাখি ঘাড় বেঁকিয়ে লক্ষ্য করল, কিভাবে দুটো মানুষ পাগলের মত ছুটতে ছুটতে সদর দরজা খোলা রেখেই পালিয়ে গেল।জোৎস্ন্যাস্নাত বাড়িটার ওপর নেমে এল এক নিঃসীম মহাশুন্যতা।

ল্যাবের ভেতরে অচিন্ত্যর নীলচে পায়ের পাতা আস্তে আস্তে তার শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেল। খাবারের উৎস যখন আর কোনও কাজের নয়, তখন তার সাথে থেকে কোনও লাভ নেই।

অবশ্য নতুন খাদ্যের অভাব নেই এখানে।

                              
                                                                                               প্রথম প্রকাশ: দেশ প্রত্রিকা, ১৭-১-২০০৮
   

1 comment: