অনন্তগজদন্তকান্ড

রাত জেগে বিশ্বকাপের খেলা দেখার পর ভোর চারটে নাগাদ সবে একটু চোখ বুজেছিল মিকি। কিন্তু সাড়ে পাঁচটা বাজতে না বাজতেই বড়রাস্তার গাড়ির হর্ন, পাশের বাড়ি থেকে সারাউন্ড সাউন্ডে বাজানো উৎকট রাম-ভজন আর পাশের গলিতে পাউরুটিওয়ালার হাঁকাহাঁকিতে ঘুম চটকে গেল তার। আর ঘুমনোর চেষ্টা বৃথা জেনে ব্যাজার মুখে উঠে পড়ল সে। যবে থেকে বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে একরাতও ঠিকমতো ঘুম জোটেনি তার। একটা জামা গলিয়ে চোখ রগড়াতে রগড়াতে বেরিয়ে পড়ল মিকি; বাড়ির বাকি সবাই এক আত্মীয়ের বিয়ে উপলক্ষে তিন দিনের জন্য গ্রামে, কাজেই এহেন অবস্থায় ঘুমের ঘোর কাটিয়ে চাঙ্গা হয়ে ওঠার একমাত্র দাওয়াই হল দেবুদার দোকানের স্পেশ্যাল চা। 

দোকানের বাইরের বেঞ্চিতে বসে চায়ে গোটা দুই চুমুক দিতেই টিঙ্কুর উদয়। মনে মনে খুশি হল মিকি। গত কয়েকদিনে টিঙ্কুকে দেখা যায়নি। ওকে সামনা-সামনি খোঁচানোর এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর মিলবে না।

একটা চায়ের অর্ডার দিয়ে মিকির পাশে বসে পড়ল টিঙ্কু। তার চোখ দুটো তরমুজের মত লাল, নীচে কালি। রাত জেগে খেলা দেখার স্পষ্ট ছাপ। নড়েচড়ে একটু জুত করে বসল মিকি।

“খেলা দেখলি কাল রাতে?” প্রশ্ন করল মিকি। 

"হ্যাঁ, ফ্রান্স, জার্মানি, আর্জেন্টিনা তিনটেই শালা লাকের জোরে বেরিয়ে গেল,” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল টিঙ্কু। 

“কোয়ার্টার ফাইনাল জমে যাবে কিন্তু,” বলল মিকি। 

“হুঁ,” অন্যমনস্কভাবে বলল টিঙ্কু। দেবুদা এসে তার হাতে একটা চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে গেল। একটু দূরে পাড়ার কিছু জেঠু-জেঠিমারা গোল হয়ে বসে প্রাণায়ম করছেন। 

এবার আসল ইস্যুতে নেমে পড়ল মিকি। গলা খাঁকারি দিয়ে একটু ভাবুক সুরে শুরু করল, “আমেজ, ড্যামেজ, নন ভেজ, ফ্রন্ট পেজ...”

টিঙ্কু ভুরু কুঁচকে তাকাল, “এ আবার কি?”

"আইস এজ, ব্লাইন্ড রেজ, গার্ডেন হেজ, কাটিং এজ...” 

"লে হালুয়া, তোর আবার কি হল?” টিঙ্কুর গলায় চিন্তা। 

"সুয়ারেজ কে নিয়ে কবিতা লিখব ভাবছি,” বলল মিকি। "হোমেজ, মহা তেজ, ক্লিভেজ, মিটার গেজ...”

“লজ্জা কর শালা, লজ্জা কর,” বলল টিঙ্কু। "সুয়ারেজ এর মত প্লেয়ার পেলে তোর ম্যান ইউ বর্তে যেত, আর তোর ইস্টবেঙ্গল তো মেঘে চড়ে নাচত!”

টিঙ্কু লিভারপুল আর মোহনবাগানের গোঁড়া সমর্থক। ওর ক্লাব-প্রেম এতটাই বেশি যে এবারের বিশ্বকাপে উরুগুয়ে-কে সমর্থন করেছে শুধুমাত্র লুই সুয়ারেজ এর জন্য। মিকি নিজে ইস্টবেঙ্গল আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-এর সমর্থক; লিভারপুল এবারের প্রিমিয়ার লিগে ইউনাইটেড-এর চেয়ে ভালো খেলায় গোটা সিজন জুড়ে সে টিটকিরি খেয়েছে টিঙ্কুর কাছে। ভেবেছিল ইস্টবেঙ্গল কলকাতা লিগ জেতার পর ভালো করে শোধ তুলবে কিন্তু তারপরেই মোহনবাগান বড় ম্যাচে জিতে যাওয়ায় সে পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায়। কিন্তু কিছুদিন আগে ইতালি-উরুগুয়ে ম্যাচ চলাকালীন লুই সুয়ারেজ এক প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারের কাঁধে মোক্ষম কামড় বসিয়ে নিজের সাসপেনশন আর তার দেশের বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়াটা পাকা করে ফেলে। টিঙ্কুকে একহাত নেওয়ার এরকম সুযোগ মিকি আবার কবে পাবে ঠিক নেই, কাজেই আজ সে একেবারেই ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। 

"তাই? তোরা খুব খুশি বুঝি ওকে নিয়ে?” মুচকি হাসল মিকি, "তা সুয়ারেজের কল্যাণে কটা ট্রফি জিতেছে শুনি লিভারপুল?” 

“ও হল শিল্পী,” বলল টিঙ্কু। "শিল্পী বুঝিস? আর্ট রে, আর্ট। চারটে ডিফেন্ডার রাখ, পাঁচটা রাখ, ও ঠিক ফাঁক খুঁজে বেরিয়ে যাবে। ইউটিউবে গিয়ে ওর গোলের ক্লিপিংস দেখবি, তোদের ওই ভ্যান পার্সি সুয়ারেজের ধারেকাছে লাগে না। এরকম প্লেয়ারের ট্যালেন্ট ট্রফি দিয়ে বোঝা যায় না, বুঝলি?”

“না, ট্যালেন্ট আছে তা তো মানতেই হবে,” বলল মিকি। "তিন তিনটে কামড়, কয়েক গন্ডা বেবাক প্লে-অ্যাক্টিং, আজে বাজে ফাউল, রেসিস্ট মন্তব্য... তাও ওই ঘানা ম্যাচের হ্যান্ডবল ছাড়া একবারও লাল কার্ড দেখেনি। কম ব্যাপার? আর তাছাড়া লিভারপুলের মত টিমকে একাই টেনেছে, নইলে দেখ হয়তো মোহনবাগানের মত রেলেগেশন বাঁচাতে হত।"

"হ্যাঁ আর তোদের কি হাল?” সামান্য চটেছে টিঙ্কু, “ফার্গু যেতেই সব শেষ। সাত নম্বরে। চ্যাম্পিয়ন্স লীগ তো ভুলে যা, ইউরোপা-তে খেলার সুযোগও জুটল না। দেখ, কত প্লেয়ার তোদের দিকে ঘুরেও তাকাচ্ছে না মিড টেবল ক্লাব বলে।"

“আমার হয়তো মেমোরি ভুলভাল বলছে,” মিকি মাথা চুলকে বলল, “কিন্তু গেল সিজনে তোরা ইউরোপিয়ান লেভেল এ কোন লীগে খেলেছিলি যেন? আর তার আগেরবার তোরা যেন প্রিমিয়ার লীগে কত নম্বরে ছিলি? ওই যেবার আমরা চ্যাম্পিয়ন হলাম?” 

“একটু জোরে বল,” চায়ে চুমুক দিয়ে বলল টিঙ্কু। "তোদের ক্লাব লীগে এত নীচে আছে যে আওয়াজটা এসে পৌঁছচ্ছে না।"

“তোরা লাস্ট কবে যেন লীগ জিতেছিলি?” মিকি চালিয়ে গেল, “আর এবার এত লাফালি ট্রফি আসবে বলে, শেষে এফ এ কাপে আর্সেনাল তোদের ডুবিয়ে দিল। হা হা, আমরা এত বাজে খেলেও আর্সেনালের কাছে হারিনি।"

"ওই আর্সেনালকেই বল, ওরা লীগ টেবলে তোদের কাছাকাছি আছে, তোদের কথা শুনে আমাদেরকে বলে দেবে,” বলল টিঙ্কু।

“আর্সেনাল তোদের কাঁচকলা দেখিয়ে অ্যালেক্সিস স্যাঞ্চেজকে নিয়ে পালাবে,” বলল মিকি।

“আর তোরা ভ্যান গাল আর ভ্যান পার্সিকে নিয়ে মিড টেবল-এ ভ্যানতাড়া ভাজবি," উত্তর দিল টিঙ্কু।

“বলিস না, বলিস না,” গলা চড়াল মিকি, “বিশ্বকাপে ভ্যান পার্সির হেড করা গোল দেখেছিস? ডলফিন লজ্জা পেয়ে যাবে শালা। দেখবি এবার ভ্যান পার্সি আর ভ্যান গাল মিলে নেদারল্যান্ডসকে চ্যাম্পিয়ন করে দেবে।"

“তুই এটা বলতে পারলি?” টিঙ্কুর চোখ কপালে উঠেছে, “তুই না ব্রাজিল সাপোর্টার?” 

“না... মানে,” একটু আটকে গেল মিকি, “এটা একটা অবজেক্টিভ স্টেটমেন্ট।"

“তাই বুঝি?” টিঙ্কুর মুখে মিষ্টি হাসি। 

“আর তুই মিড টেবলের দুয়ো দিচ্ছিস?” মিকি পাল্টা আক্রমণে গেল, “মোহনবাগান আই লীগে কত নম্বরে আছে রে? লাস্ট কবে ট্রফি জিতেছিস তোরা?”

“বকিস না রে বকিস না,” বলল টিঙ্কু। "দু'দিন ভালো খেলে খুব উড়ছিস। দাঁড়া, একত্রিশে আগস্ট আসুক, কলকাতা লীগের বড় ম্যাচে গুনে গুনে চার গোল দেব শালা।"

“তুই যে টিমকে সাপোর্ট করিস তাদেরই এমন হাল হয় নাকি রে?” দাঁত বের করে হাসল মিকি, “ছি ছি, আর্সেনাল-ও একটা ট্রফি জিতেছে গেল সিজনে...”

“ওরে, যতই লাফা, ন্যাশনাল ক্লাবের ধারে কাছে লাগে না তোর ইস্টবেঙ্গল,” রেগে গেছে টিঙ্কু। "আমরা গোটা দেশকে ফুটবল খেলতে শিখিয়েছি। খালি পায়ে ব্রিটিশদের হারিয়েছি। স্বাধীনতা সংগ্রাম, বুঝলি কিছু? তোদের মত হাজারটা ক্লাব আসবে যাবে, কিন্তু মোহনবাগান চিরকাল থাকবে।"

“হ্যাঁ হ্যাঁ, আর ম্যাচ হারছে দেখলেই টিম তুলে নেবে, তারপর হাতে পায়ে ধরে সাসপেনশন কাটাবে,” বলল মিকি। "আর পরে রেলেগেশন বাঁচিয়ে নাচানাচি করবে।"

"আর তোরা রেফারিকে চুল্লু খাইয়ে ম্যাচ জিতবি,” বলল টিঙ্কু। "তোদের সেই ক্লাসটাই নেই, বুঝলি? ক্লাস বুঝিস? ট্র্যাডিশন, প্রিন্সিপল, যেরকম লিভারপুলের আছে। এসব আলাদা ব্যাপার, তোর মাথায় ঢুকবে না।"

“তাই দেখছি তো,” মুচকি হাসল মিকি। "বিশ্বকাপেও স্টিভেন জেরার্ড সুয়ারেজকে পাস দিয়ে গোল করাচ্ছে। লিভারপুলের ব্যাপারই আলাদা।"

“দেখবি, আরও দেখবি,” বলল টিঙ্কু। "সিজন শুরু হতে দে না। সব ব্যাটাকে দেখিয়ে দেব এবার। ইউনাইটেড সিটি আর্সেনাল সব ভেগে যাবে।"

“কেন রে, কামড়াতে আসবি নাকি?” ভালোমানুষের মত মুখ করে বলল মিকি।

“ওই বললাম তো, লুই সুয়ারেজের মত প্লেয়ারের কদর তুই বুঝবি না,” টিঙ্কু বলল। "কত গরিব ঘর থেকে উঠেছে জানিস? সাত ভাইবোনের একজন ছিল। ছোটবেলায় সুইপারের কাজ করে পেটের ভাত জোগাড় করত। ওই প্লেয়ারের নাম মুখে নেওয়াও তোকে মানায় না।"

"তাই বল, তাহলে তো কবিতাটা বেশ ভাবগম্ভীর করতে হবে দেখছি,” বলল মিকি। "একটু হাঙ্গার-টাঙ্গার থিমে ঢোকাতে হবে, সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের মত। ইন ফ্যাক্ট,” মিকি চোখ বন্ধ করে একটা হাত তুলে ধরল, “এখনই আমার মাথায় কয়েকটা লাইন এসেছে। শুনে বল তো কেমন হয়েছে...
প্রয়োজন নেই সাম্বার স্নিগ্ধতা,
টিকি-টাকা আজ তোমাকে দিলাম ছুটি;
ক্ষুধার রাজ্যে ফুটবল গদ্যময়
চেলিনির কাঁধ যেন ঝলসানো রুটি।"  

“উফ কি দিলি,” দু'বার হাততালি দিল টিঙ্কু। "ওরিজিনাল ফেল করে যাবে।"

চা শেষ হয়ে গেছে। দু'জনেই দাম চুকিয়ে উঠে পড়ল। তাদের বাড়ি পাশাপাশি দুটো গলিতে, কিছুদূর তাদের একসাথেই যেতে হবে।

একটু হাঁটার পর মিকি প্রশ্ন করল, “হ্যাঁ রে, তুই সুয়ারেজকে এত ডিফেন্ড করছিস কেন? ও তো তোদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে!”

টিঙ্কু দাঁড়িয়ে পড়ল, “মানে?”

“মানে বার্সেলোনা ওকে চাইছে, দর উঠেছে সত্তর মিলিয়ন পাউন্ড,” বলল মিকি। "লিভারপুলও ওকে চালান করে দিতে চাইছে। কেন তুই নিউজ ফলো করিস না?” 

“ইন্টারনেট প্যাক শেষ হয়ে গেছে, ভাবলাম দু'দিন পরে রিচার্জ করব,” শুকনো গলায় বলল টিঙ্কু। 

“বাঃ, তাই ভাবি হোয়াটসঅ্যাপ-এ মেসেজ ডেলিভার হচ্ছে না কেন,” মিকি বলল। "সানি লিওনের একটা ভিডিও পাঠিয়েছি, দেখে নিস।"

“হুঁ,” মাথা নিচু করে বলল টিঙ্কু। 

“তুই এত আপসেট হচ্ছিস কেন?” মিকি জিজ্ঞেস করল, “জানিস তো সুয়ারেজ এরকমই করে। অ্যাজাক্স-এ যখন খেলত তখনও একজনকে কামড়েছিল অন্য ক্লাবে ট্রান্সফার নেওয়ার জন্য। তারপর প্রিমিয়ার লীগে এভরাকে কামড়াল সেটাও লিভারপুল থেকে অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য। সেবার যেতে পারল না তাই এবার বিশ্বকাপে কামড়াল যাতে এফেক্ট-টা আরও বেশি হয়। বেশি টাকায় অন্য ক্লাবে যাওয়ার ধান্দা।"

"না রে, ও কামড়ায় অন্য কারণে,” বলল টিঙ্কু। 

"মানে?” অবাক গলায় বলল মিকি। 

"ওর সামনের দুটো দাঁত দেখেছিস? গজদন্ত দুটো?” টিঙ্কু বলল, “ওইরকম দাঁত কাদের হয় বলতো? ইঁদুরদের। আর ওদের দাঁত চিরকাল বেড়েই চলে। তাই ওরা সবসময় সবকিছুকে কামড়ে আর চিবিয়ে বেড়ায় দাঁতকে ঘষে ঘষে ছোট করার জন্যে। নইলে সেটা এত বড় হয়ে যাবে যে ওটাকে টানতে টানতে চলে ফিরে বেড়ানো মুশকিল হয়ে যাবে।" 

মিকি হাঁ করে তাকিয়ে রইল। 

“কাজেই সুয়ারেজ-এর কামড়ানোটা হল গিয়ে ইন্সটিঙ্কট-এর ব্যাপার। ইন্সটিঙ্কট বুঝিস? গোদা বাংলায় যাকে বলে সহজ প্রবৃত্তি,” বলল টিঙ্কু।

“উরে ত্তারা!” মিকির ততক্ষণে মাথায় হাত, "তুই তো মহা পাল্টিবাজ দেখছি? নিজের হলেই গোষ্ঠ পাল, ক্লাব ছাড়লেই তাপস পাল? কি সাংঘাতিক!”

“কেন? প্লেয়াররা যখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে চলে যায় তখন তুই কি করিস?” টিঙ্কু বলল, “বেকহ্যাম যেবার গেছিল তুই কান্নাকাটি জুড়েছিলি। আর ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর বেলায় ওর বাপ-বাপান্ত করেছিলি। ভুলে গেছিস?”

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল মিকি। তারপর বলল, “তাহলে বুঝলি তো, রিয়াল মাদ্রিদ-কে দেয় কে?”

“ধুস শালা,” হেসে ফেলল টিঙ্কু। 

6 comments: